সিগনাল টা লাল হতেই
মায়া একটু হেঁটে, একটু দৌড়ে রাস্তা পার হল।এবং বুঝল বেশ কিছু জোড়া চোখ তাকে লক্ষ
করছে। পাত্তা না দিয়ে বরং একটু শ্লথ পায়ে চুল টা ঠিক করে নিল। পার্ক এর বাইরে
মেশিন গান নিয়ে বেশ কিছু উর্দি পরা গার্ড। মায়ার দিকে চোখ যাওয়ার কারন অবশ্যই
মায়ার রুপ বা শরীর নয়, বা তার থেকেও বড়, একটা অল্প বয়েসি যুবতী মেয়ের একা রাস্তায় চলা ফেরা। জায়গা
টা ইরাক, ঠিক বাগদাদ নয়, কিন্তু পার্শ্ববর্তী শহর। যুদ্ধের কিছুদিন আগে। এখানে
মেয়ে রা মুসলমান, কিন্তু সবাই বোরখা পড়ে না। যারা পরেন তারা বেশিরভাগ শুধু মাথা
টুকু কাপড়ে ঢেকে রাখেন। তাই চুল খোলা মেয়েটা এদের কাছে
খুব বড় ব্যাপার না হলেও, মেয়েরা সাধারনত এখানে একা রাস্তায় বেরোয় না। সঙ্গে
স্বামী, বাবা, ভাই নিদেন পক্ষে মা বা তৎসম বয়স্ক মহিলা থাকেন। কিন্তু মায়ার উপায়
নেই। মায়া এখানে একটা কমুনিকেশান প্রোজেক্ট এর কাজে এসেছে। প্রায় তিন মাস হয়ে গেল।
বন্ধু বান্ধব একেবারেই নেই বলা ভুল, তবে বিকেলে দৌড়নোর সময় টা মায়া একা থাকাই বেশি
পছন্দ করে। রোজ অফিস ফেরত হয়ে ওঠে না, তবে আজ শুক্রবার। এদের আজ নামাজ পড়ার দিন।
ছুটি।
ছোট্ট কামরার ভেতর
নিজের শরীরে লুকোনো অস্ত্র নেই দেখিয়ে পার্ক এর ভেতর ঢুকল মায়া। বাঁ দিকে বিশাল
বেদি, স্মারক, পুরনো বম্ব ব্লাস্ট এর স্মৃতি। টাক মাথা একজন ভদ্রলোক এক হাথে ফোন
আরেক হাথে এক মহিলার হাথ ধরে বেশ খানিক রগড় করে চলেছেন। মায়া কে দেখে বলে উঠলেন,
‘ফোতো, ফোতো’। এদের কে মায়া চেনে না। আবার চেনেও। ভদ্রলোক মায়ার ক্লায়েন্ট
কম্পানির মারকেটিং হেড, মাজিন আবদুল্লাহ। মেল চালাচালি হয়েছে, কিন্তু সামনা সামনি
কখনো দেখা হয়নি। সঙ্গের মহিলার নাম আফাফ, ওনার বিবি। মহিলা ভীষণ ভাবে না না করতে
করতে হাথ ছাড়িয়ে স্মারক এর দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালেন, দৃষ্টি দূর এর গাছ এর দিকে।
আবদুল্লাহ মায়া কে ছেড়ে আবার আফাফ এ মন দিলেন। নিজের মনেই হেসে ফেলে পা বাড়াল
মায়া।
দু পাশে বিরল গাছ এর
সারি, ফুল বাগান, ফুলকপির মতন বড় গলাপ ফুল, সাদা, কম্লা, হাল্কা হলুদ, গোলাপি। চুল
টা আরেকটু টেনে টাইট করে নিয়ে, হাল্কা পায়ে দৌর শুরু করলো মায়া। বেশ খানিক টা গেলে
একটা বেশ বড় লেক, পার্ক এর ভেতরেই। এখানে একটু দাঁড়াবে মায়া। চারপাশে চোখ বুলিয়ে,
জল এর দিকে একটু স্থির তাকাবে। এটাও মায়ার আনেক দিনের অভ্যেস। জল এর দিকে তাকিয়ে
থাকা। এমন সময় একটা অল্প বয়েশি ছেলে কে দেখল মায়া, গলফ কার্ট চালিয়ে আসতে। ইরাকি। মায়ার
থেকে একটু দূর এ গিয়ে দাড়িয়ে, পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল। ছেলে টা কে একটু
অস্থির মনে হল, বারবার এদিক ওদিক দেখছে, কিছু যেন খুঁজছে, একবার জামার ভেতরে হাথ
দিলো। এবার ভয় পেল মায়া, সুইসাইড বম্বার নয়তো? দুটো ঢোঁক গিলে মায়া এবার একটু গলা
খাঁকারি দিলো। ছেলে টা ঘাবড়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে কিরম একটু অদ্ভুত হাসি হাসি মুখ
করলো। ছেলে টার মুখ দেখে মায়ার মনে হল এ ছেলে বম্বার হতেই পারে না, যদিও আগে কখনো
সুইসাইডবম্বার দেখেনি, তবু মনে হল, এটাই বোধয় ইন্সটিঙ্কট। মায়া পাল্টা হাসি ফেরত
দিয়ে কেটে পড়ল লেক এর পাশ থেকে। মাঝখান থেকে জল টাই ভাল করে দেখা হল না ভেবে দুঃখ
করতে যাবে এরম সময় একটা নতুন সাইন বোর্ড চোখে পড়ল, এটা তো আগে কখনো দেখেনি।
‘রানিং ট্র্যাক ২.৫
কিমি.’ লেখা বোর্ড টার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল জায়গা টা। লাল মাটির রাস্তার
মতন, দু পাশে রেলিং দেওয়া, রানিং ট্র্যাক। ঠিক স্টেডিয়াম
এর মতন। দোনামোনা করে
দৌড়তে যাবে, একটা বেশ লম্বা, ভীষণ সুন্দর দেখতে ছেলে দৌড়ে গেলো মায়ার সামনে দিয়ে।
মায়ার দিকে বোধয় একবার তাকালও। এটুকুই যথেষ্ট ছিল মায়ার দৌড়নো শুরু করার জন্যে। দু
পা ফেলতেই বেশ আরাম লাগল, কংক্রিট এর রাস্তায় দৌড়ানোর থেকে বেশ ভাল, আর আনেক
মহিলাও আছেন, আলাদা করে চোখে পড়ার সমস্যা নেই। কিন্তু সে কই, যার জন্যে আসা।
দ্বিতীয় বার চক্কর কেটে সেন্টার কোর্ট এ এসে একটু থামল মায়া। নাহ, কোথাও নেই।
পার্ক টা এতটাই বড় যে কোনোদিকে গিয়ে খোজাও প্রায় অসম্ভব। যে কোনও অন্য গেট দিয়ে
বেরিয়ে গেলেও বুঝতে পারা মুশকিল। মায়া নিজেকে ধমক দিলো এবার একটু, ‘এবার বারাবারি
হচ্ছে মায়া’। পড়ে থাকা একটা জিম ম্যাট টেনে শুয়ে পড়ল মায়া, দু তিন টে ফ্রি-হ্যানড
করবে। চোখ বুজে কতখন এভাবে শুয়েছিল জানেনা, একটা অচেনা ‘হাই’ শুনে চটকা ভাঙল।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরিজি তে বলে উঠল ফরসা ছেলে টা ‘তুমি কতক্ষণ ম্যাট টা ইউস করবে’।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে ম্যাট ছেড়ে দিলো মায়া। খানিক্ষন কথা বলে জানল, ছেলে টার নাম
ক্লেমেন্ত, ফ্রেঞ্চ। এখানে ইউ এন এর হয়ে সিরিয়ান রিফিউজি দের জন্যে কাজ করে। মায়া ভারতীয়
শুনে জানাল যে ২০০০ সালে রাজস্থান বেড়াতে এসেছিল বন্ধুদের সাথে। আশেপাশে বেশ কিছু
বাচ্ছা ফুটবল খেলছে। মায়া ক্লেমেন্ত এর পাশে এসে দাঁড়াল। একথা সেকথার পর ক্লেমেন্ত
জিজ্ঞ্যাসা করলো মায়া একা এসেছে কিনা। সন্ধেবেলায় কাছেই একটা কমুনিটি সেন্টার এ
ইউ-এন ইরাক এর সদস্য দের একটা জমায়েত আছে, মায়া চাইলে ক্লেমেন্ত এর সাথে সেখানে
সন্ধ্যে টা কাটাতে পারে।
মায়া না করলো না,
এমনিতেও বেশির ভাগ সময় টা একাই কাটে মায়ার, নতুন কিছু মানুষের সাথে পরিচয় হওয়ার
লোভ সামলাতে পারা মুশকিল। ক্লেমেন্ত ও বেশ কিছু ফ্রি-হ্যানড কসরত করে উঠে পড়ল।
সামনেই দিভান হোটেল, পার্ক থেকে বেরোনোর গেট এর ঠিক উলটো দিকে, সেই রাস্তাই ধরল
দুজনে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, পার্ক এ এখন লোকজন বেশ কম, হলুদ হ্যালোজেন গুলো জলছে।
গেট এর কাছাকাছি এসে মায়া ক্লেমেন্ত এর কাছে এক মিনিট সময় চেয়ে নিলো। একটু ওয়াশরুম
যেতে হবে।
ওয়াশরুম এর বাইরে
মাজিন আবদুল্লাহ, ফোন হাথে সিগারেট খাচ্ছেন। মায়া দেখল ক্লেমেন্ত ‘এক্সকিউস মি’
বলে এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে। ছেলে দের সেকশান টা পেরিয়ে, মেয়েদের ওয়াশরুম এ ঢুকতে
গিয়ে চোখে পড়ল, একটু দূর এ ঝোপ এর আড়ালে দাঁড় করানো একটা গলফ কার্ট। এটাই সেই আগের
দেখা গলফ কার্ট কিনা চিন্তা করতে করতে ভেতরে ঢুকল মায়া। কাজ সেরে, আয়নার সামনে
দাড়িয়ে কাজল টা অল্প ঠিক করে নিলো। ভেতরে খুব বেশি আলো নেই। তবুও দেখতে পেলো, আফাফ
দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু কেও যেন ধরে আছে আফাফ এর হাথ দরজার ওপাশ
থেকে। আফাফ এর গলায় মিনতির স্বর, মায়া কে এখনো দেখতে পায়নি। একবার সামান্য ভেতরে
ঢুকে গিয়ে আবার জোর করে হাথ ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলো আফাফ। মায়া স্তব্ধ। দু হাথে মুখ ঢেকে
ফেলল আফাফ, কোনোরকমে মাথার ওড়না
ঠিক করে দ্রুত বেরিয়ে গেলো, মায়ার দিকে না তাকিয়ে।
ধীর পায়ে বাইরে এলো
মায়া, ক্লেমেন্ত অপেক্ষা করছে। আর কাউকে চোখে পড়ল না আশেপাশে। ক্লেমেন্ত এর সাথে
পার্ক এর বাইরে বেরিয়ে এসে একটা গাড়িতে উঠে বসলো। পার্ক এর সামনে দিয়ে গাড়ি টা
বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখল সেই লম্বা সুপুরুষ ছেলেটি, এদিকেই তাকিয়ে আছে, অদ্ভুত চোখ,
তবে মায়ার দিকে তো তাকাচ্ছে না। খানিক হতভম্ব হয়ে পাশে বসা ক্লেমেন্ত এর দিকে
তাকাল মায়া। ক্লেমেন্ত মায়ার দৃষ্টি অনুসরন করে বাইরে তাকিয়ে মায়ার চোখে চোখ রাখল।
বলে উঠল ‘ওদিকে তাকিয়ো না’।